হিংলাজ শক্তিপীঠভগবান বিষ্ণুর চক্রে দেবী সতীর দেহের বিভিন্ন অংশ পবিত্র ভারতভূমির নানা প্রান্তে পতিত হয়েছিল। অন্তরীক্ষ থেকে দেবীর বিভিন্ন অংশ জলন্ত উল্কার ন্যায় ধরিত্রীর বুকে এসে পড়ছিল। কিছু স্থানে সেই অংশ মাটিতে পড়ে অনেক নীচু পর্যন্ত ডেবে যায়। সেই অংশ গুলি থেকে ভগবতী মা মহামায়ার বিভিন্ন অংশ প্রকট হচ্ছিলেন। দেবীর এই অংশগুলির ভার কিছু স্থানে ধরিত্রী মাতাও সহ্য করতে পারছিলেন না। পরবর্তী কালে দেখবো দেবীর যোনি পীঠ নীল পর্বতে পতিত হলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ পর্বত সেই ভার সহ্য করতে না পেরে পাতালে প্রবেশ করছিল । অতঃ পর দেবতাদের প্রার্থনায় মা নিজে দয়া করে সেই তিন পর্বতকে ধারন করলেন। তিন পর্বত পাতালে আর ডেবে গেলো না। যখন দেবীর বিভিন্ন অংশ পতিত হচ্ছিল্ল – দেবতাগণ করজোড়ে দেবীর নানা স্তব স্তুতি করছিলেন । দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র এসে পতিত হল বালুচিস্তানের মাকরাণ নামক স্থানে । এখানে দেবী হলেন কোট্টরা আর ভৈরব হলেন ভীমলোচণ । শিবচরিত, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, তন্ত্রচূড়ামণি মতে এই তীর্থ কে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানে । পাকিস্তানের করাচি শহর থেকে নব্বই মাইল দূরে বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে এই তীর্থ। প্রায় সমস্ত শক্তি পীঠের মতো এই স্থানেও দেবীর অঙ্গ শিলা রূপী। মরুভূমিতে মরূদ্যানের মতোই এই তীর্থ ভক্তদের আকর্ষণ করে। মরুস্থলের চারিদিকে প্রায় চার হাজার ফুট উঁচু হিংলাজ পর্বত। তাঁর মধ্যে এই তীর্থ। এই পর্বত ভেদ করে হিঙুলা নদী বইছে । এই পীঠে যাবার রাস্তা খুব দুর্গম । কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণ পার করে যেতে হয়। এখানে নদীতে গন্ধকের মাত্রা প্রচুর। এই স্থানে পানীয় জলের অভাব ও মরুঝড় এর তাণ্ডব লক্ষ্য করা যায়, তাই তীর্থ যাত্রীরা একেবারে সেই মতো তৈরী হয়ে যান । হিংলাজ পীঠ পৌছাবার আগে চন্দ্রকূপ নামক একটি উষ্ণ কুণ্ডের সামনে প্রথমে পূজো দিতে হয় । এই কূন্ডের জল ফুটতে দেখা যায়। কথিত আছে এখানে লোকে নিজের কুকর্মের কথা জানালে মা তাঁকে ক্ষমা করেন। অবশ্য মায়ের কাছে অজ্ঞাত কিছুই না। তবুও অন্যায় স্বীকার, প্রায়শ্চিত্ত এক বড় ব্রত। এতে মন শুদ্ধ হয় । দেবী হিংলাজের মন্দির একটি গুহাতে । মুসলিম গন এই দেবীকে ‘বিবি নানী’ নামে ডাকেন । ঐতিহাসিক দের মতে প্রাচীন কুষান যুগে কুষান দের মুদ্রায় ‘ননদেবী’ নামক এক দেবীর মূর্তি অঙ্কিত থাকতো। ঐতিহাসিক বিচারে সেই দেবী হলেন হিংলাজ । হিংলাজ পর্বতের নীচের দিকে একটি সুরঙ্গ আছে । বিশ্বাস ঐ সুরঙ্গ যোণিস্বরূপ । এবং সেখান দিয়ে যা নিয়ে যাওয়া হয়- তাই প্রসাদ হয়ে যায় । এখানে অনেক পশু বলি হয় । এই দেবীকে ‘মরী’ নামেও ডাকা হয় । এখানে একটি কূয়ো আছে। বগ্ বগ্ করে যার থেকে শব্দ বের হয় । এখানে ভক্তেরা সুপারী, এলাচ, লবঙ্গ, নারিকেল অর্পণ করেন । বলা হয় এই পীঠে দেবী জ্যোতি রূপে বিরাজিতা। ভূগর্ভ থেকে সত্যই আগুনের শিখা ওঠে । এখানে ভগবান শঙ্কর , ভীমলোচণ ভৈরব রূপে আছেন। অভিনব গুপ্তের ‘তন্ত্রালোক’ এর মতে ভৈরব শব্দের উৎপত্তি ‘ভিয়ে’ অর্থাৎ অধম অধিকারীর ভয়ের নিমিত্ত ( রবো যা সাং তা ভীরবাঃ ) থেকে । পরম শিব তাঁদের স্বামী- তাই তাঁর নাম ভৈরব । তিনি সুখ দুঃখতে ভরা সংসার থেকে মুক্তি দান করেন বলে তাঁর নাম মহাভীম বা ভীষণ । এই দেবীর পূজাতে প্রধান উপকরণ হল সিঁদুর ও শুকনো ফল। মন্দিরের সামনে পূজো দেবার ডালা কিনতে পাওয়া যায় না। তাই দূর থেকে নিয়ে আসতে হয় । মা হিংলাজ রক্তকরবীর পুস্প খুব ভালোবাসেন । এখানে বালি ভূমিতেও রক্তকরবীর গাছ দেখতে পাওয়া যায় । আসুন আমরা ভগবতী হিংলাজ কোট্টরা মাকে প্রনাম করি এই দূর থেকে । জানিনা মা কখনো সেখানে যাওয়ার সুযোগ দেবেন কিনা! মা সর্বত্র বিরাজমানা । তাই এখানে বসেই জগৎজননী কে প্রনাম জানিয়ে বলি “ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো দেহি” । মা রূপ দাও, যশ দাও, জয় দাও,শত্রু নাশের শক্তি দাও । হেভগবতী তুমি গতি। ( আগামী পর্বে থাকবে করবী শক্তিপীঠ )